কঠিন পাথরের রত্ন নয়, বরং নরম তুলা দিয়ে তৈরি এক অমূল্য সম্পদই যেন। শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় অসামান্য কারুকাজ খচিত সে জিনিস, যার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছিল পুরো বিশ্বই। সেই মোঘল আমল থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের রাণী, কে না তারিফ করেছে এর নান্দনিকতার! নাম তার জামদানি শাড়ি।

তবে এই শাড়িকে সাধারণ ১২/১৩ হাতের শাড়ি ভাবলে ভুল হবে, এর সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, অহংকার ও আর তাঁত শিল্পের নিপুণতা। বাংলাদেশের যেসব নারী শাড়ি পছন্দ করেন, তাদের সংগ্রহে অন্তত একটি হলেও জামদানি শাড়ি আছেই। নান্দনিক ডিজাইন এবং দামে বেশি হওয়ার কারণে জামদানির সঙ্গে আভিজাত্য এবং রুচিশীলতা – এই দুটি শব্দই জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে।

জামদানী বলতে আমরা মূলত শাড়ি বুঝলেও এটি দিয়ে কুর্তি, পাগড়ী, রুমাল প্রভৃতি এবং ১৭০০ শতকে শেরওয়ানি তৈরির চল ছিলো। কারপাস তুলা থেকে বানানো সুতার নানান রঙের বুননে গড়ে ওঠা নকশাবাহী জামদানী শুধু আভিজাত্যই নির্দেশ করেনা বরং এটি বিয়ের কনের ক্ষেত্রেও পছন্দসই পোশাক বটে। প্রাচীনকালে তাঁত বুনন প্রক্রিয়ায় কার্পাশ তুলার সুতা দিয়ে মসলিন নামে সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি হতো এবং মসলিনের উপর যে জ্যামিতিক নকশাদার বা বুটিদার বস্ত্র বোনা হতো তারই নাম জামদানি।

সম্ভবত মুসলমানরাই জামদানির প্রচলন করেন এবং দীর্ঘদিন তাদের হাতেই এ শিল্প একচেটিয়াভাবে সীমাবদ্ধ থেকেছে। ফারসি থেকেই জামদানি নামের উৎপত্তি বলে অনুমান করা হয়। বয়নশিল্পের ঐতিহ্য দক্ষিণ এশিয়ায় চার হাজার বছরের। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলা ব-দ্বীপে তুলার চাষ ও উত্পাদন, বিভিন্ন রকম অসাধারণ মসৃণ কাপড়ের জন্য বিশেষ জায়গা দখল করে আসছে বহু বছর ধরেই। ব-দ্বীপ অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তর ঢাকা প্রাচীনকাল থেকে মসলিনের উত্পাদন ও বাণিজ্যের জন্য অন্যতম জায়গা ছিল। অনুমান করা হয় যে মসলিনের মধ্যে ৩৬টি ভিন্ন ভিন্ন পণ্য রয়েছে। জামদানি তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম।

জামদানির জন্ম হয়েছিল আদি ঢাকায়। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর অঞ্চলে এককালে তৈরি হতো জামদানি শাড়ি। বংশ পরম্পরায় কয়েক পুরুষের হাত ধরে এর সূক্ষ্ম বয়নকৌশল আর নকশার নৈপুণ্য ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছিল জামদানি। জামদানির উল্লেখ পাওয়া যায় আনুমানিক ৩শ খ্রিষ্টাব্দে কৌটিল্য রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে। জানা যায়, বঙ্গ আর পুন্ড্র অঞ্চলে অতি মসৃন এবং সূক্ষ্ম এক ধরনের কাপড়ের প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর বর্ণনায় বাংলাদেশের সূক্ষ্ম সুতির কাপড়ের প্রশংসা করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে উৎকৃষ্ট সূক্ষ্ম মসলিনের দাম ছিল তখনকার হিসেবে প্রায় ৪শ টাকা।

সপ্তদশ শতাব্দীতে জামদানি নকশার কুর্তা ও শেরওয়ানির ব্যবহার ছিল। উৎকৃষ্ট ধরনের জামদানি ও মসলিন তৈরির জন্য ঢাকা, সোনারগাঁও এবং আশেপাশের এলাকাগুলো বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। ইউরোপীয়রা ছাড়া ইরানি, আর্মেনিয়ান, মোঘল, পাঠান বণিকরা এসব ঢাকাই মসলিন ও জামদানি ব্যবসায়ে উৎসাহী ছিলেন। ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ আরম্ভ হয় মোঘল আমলেই। এ সময়ে শুধু যে মসলিন ও জামদানি শিল্পের উন্নতি হয় তা নয়, দেশে-বিদেশে জামদানি ও মসলিনের চাহিদাও তখন থেকেই বাড়তে থাকে। মোঘলদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে জামদানি পায় বিলাসি পণ্যের সম্মান। আঠারো শতকের ইংরেজ কোম্পানির দলিলে দেখা যায় যে, ‘মলমল খাস’ ও ‘সরকার-ই-আলি’ নামক মসলিন সংগ্রহ করার জন্য ঢাকায় একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর উপাধি ছিল দারোগা-ই-মলমল। প্রত্যেক তাঁতখানায় একটি করে দপ্তর ছিল এবং সেখানে আড়ং-এর অত্যন্ত নিপুণ তাঁতি, নারদিয়া, রিপুকার ইত্যাদি কারিগরের নাম তালিকাবদ্ধ করে রাখা হতো। তাঁতখানায় তাঁতিদের কোনো নির্ধারিত বেতন ছিল না। ফলে বেতন বৈষম্য ছিল সে সময় থেকেই। দারোগার প্রধান কাজ ছিল মসলিন বা জামদানি তৈরির প্রতি পদক্ষেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা। এভাবে ঢাকা, সোনারগাঁও, জঙ্গলবাড়ি ইত্যাদি থেকে প্রায় প্রতিবছর এক লক্ষ টাকা মূল্যের মলমল-খাস মোঘল দরবারে পাঠানো হতো।